চরকা রিপোর্ট ঃ
মহান মুক্তিযুদ্ধে নারী দের ভূমিকা ছিল অন্তঃসত্ত¡া একজন মায়ের মতো। মা সন্তান কে
যেভাবে দশ মাস দশ
দিন গর্ভে ধারণ করে পৃথিবীতে নিয়ে আসেন আবার সেই সন্তানের মলিন চেহেরাটা দেখে নির্বিগ্নে ভূলে যান অতীত কস্ট বেদনা গুলো, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস নারী
পুরো দেশটাকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন। তারা পাশবিকতার শিকার হয়েছেন, লাঞ্ছিত হয়েছেন, আবার হাসি মুখে স্বামী, সন্তানকে যুদ্ধে পাঠিয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়, খাবার, আর্থিক সাহায্য দিয়েছেন, খবর আদান-প্রদান করেছেন, সেবা দিয়েছেন,মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প পাহারা দিয়েছেন, কণ্ঠ দিয়ে, শব্দ দিয়ে, যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, রণাঙ্গনে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন এবং পরিশেষে নিজে ধর্ষিত হয়েছেন আবার সন্তান জন্ম দিয়েছেন । কোথায় ছিল
না নারীর ভূমিকা? সন্তান প্রসবের পর মা যেমন
সন্তানের মুখ দেখে প্রসব বেদনা ভুলে যান, তেমনি স্বাধীনতার পর নারীরা সব
কষ্ট ভুলে হাসি মুখে দেশটাকে বরণ করে নিয়েছেন। যুদ্ধ শেষে প্রাপ্য চাননি। রাষ্ট্র তাদের মর্যাদা দিতে পারেনি। মা মেয়ের ভূমিকা
দেখা হয়, ‘২/৩/৫
লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের
বিনিময়ে’, নয়তো ‘ইজ্জতের বিনিময়ে পাওয়া দেশ’ হিসেবে। সেই সম্ভ্রম যোদ্ধাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, সেবা দিয়েছেন, সুখ দুখ গুলো ভাগাভাগি করেছেন তিনি হচ্ছেন ডাঃ হালিদা হানুম আখতার। মহান ইতিহাসের স্বাক্ষি ডাঃ হালিদা কে ইতিহাস কখনো
ভুলবেন না ।
যুদ্ধ শেষে আমেরিকা থেকে ঢাকায় আসেন হালিদা হানুম আখতার । স্বাস্থ্য বিষয়ে
উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ডাঃ হালিদা সহ দুজন ডাক্তার
পশ্চিম পাকিস্থানের আরো ছয়জনের একটি টিম করে ইউএসআইডির অর্থায়নে আমেরিকা যান। ১৯৭০ সালে অক্টোবর মাসের ২০ তারিখে রওনা
হয়ে এপ্রিল মাসের শেষে ঢাকায় ফিরে আসার কথা থাকলেও ১৯৭১ সালে মার্চে মাসে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তাদের ফিরে আসাটা পিছিয়ে যায় , তারা তিনজন ফিরে আসেন ১৯৭১ সালে ২১ আক্টোবর ।
ফিরে আসার পর পরিবার পরিকল্পনা
বোর্ড ডাঃ হালিদা কে সেবা সদন
নামে নতুন ক্লিনিকে ডেপুটেশনে চার মাসের জন্য নিয়োগ দেয় সেখানে পাক আর্মি দ্বারা নির্যাতিত নারী ,যারা গর্ভবতী হয়েছেন এবং গর্ভের সময় বেশি হয়ে গেছে তাদের ভর্তি করে গর্ভপাত ও সন্তান ডেলিভারীর
সেবা প্রদান করার ব্যবস্থা ছিল তাদের ।
জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা হয় , সবার চেহারা বিমর্ষ, এই নারীদের বাবা,
ভাই কিংবা কোন আত্মীয় ক্লিনিকে রেখে গেছে, নারীদের কেও সাত মাস বা আটমাস মাসের
গর্ভবর্তী ,এই অসহায় নারীদের
যদি কোন কারণে প্রশ্ন করা হতো ‘কি হয়েছিল’ চোখ
দিয়ে অঝোরে পানি পরতো। ওদের কান্না দেখে নিজেও একজন নারী হয়ে নিজ চোখের জল টলমল করতো
কিন্ত একজন ডাক্তার হয়ে মনোবল কে সক্ত করে
চিকিৎসা সেবা টা যেন সর্বোচ্চ
পায় তাই চেষ্টা করা হতো । যেসব ভায়োলেটেড
(ধর্ষিত) মেয়েদের গর্ভ একেবারে শেষের দিকে তারা অধিকাংশ সময়ই জীবিত শিশু প্রসব করতো; অথচ সাথে সাথেই নিজেকে শিশুটির মা হিসেবে অস্বীকার
করে বসতো এমন কি তাকিয়ে দেখতে
বা বুকে নিতেও রাজী করানো যেতো না তাদের ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় একজন আদর্শ দেশ প্রেমিক হিসেবে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন । পাকিস্তান হানাদার
বাহিনী কর্তৃক অত্যাচারিত গর্ভবতী নারীদের প্রয়োজনীয় পরিচর্যা গর্ভপাত, ডেলিভারি বিষয়ে শারীরিক সুচিকিৎসা ও মানসিক উন্নয়নসহ
পুর্নবাসন ব্যবস্থাপনার তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন । শুধু তিনিই
নন তার মা ডাঃ হুমায়রা
খানম রংপুরে অসহায় নারীদের চিকিৎসা দিয়ে এসছেন তিনি ১৯৬০ সাল থেকে প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ
হিসেবে স্বনামধন্য ছিলেন ।
ডাঃ হালিদা হানুম আখতার প্রজনন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়ে তার ৫০ বছরের বেশি
অভিজ্ঞতা, জাতীয় ও আর্ন্তজাতীক ক্ষেত্রে
তিনি সুনামের সঙ্গে খ্যাতি অর্জন করেন ।স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিদ্যায়
¯œাতকোত্তর ডিগ্রির পর ডাঃ হালিদা
হানুম আখতার জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি থেকে জনস্বাস্থ্য মার্স্টাস ও ডক্টরেট ডিগ্রি
লাভ করেন। তিনি সিডিসি সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল,
আটলান্টা, জর্জিয়া থেকে রাকাফেলার ফেলো হিসেবে (Epidemic Intelligence Services- EIS) প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হন । নারী
স্বাস্থ্য বিষয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার পাশাপাশি প্রজনন স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় তার নেতৃত্বের ভূমিকার মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের অধীনস্থ নেতৃস্থানীয় প্রজনন স্বাস্থ্য গবেষণার ইনস্টিটিউট (BIRPERHT) এর
প্রতিষ্টাতা ও তার পরিচালক
ছিলেন ।বাংলাদেশের বৃহত্তম পরিবার পরিকল্পনা সংস্থার (FPAB)
মহাপরিচালক
হিসেবে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। আমেরিকায় বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃত্বস্থানীয় একজন ব্যাক্তি । এছাড়া বর্তমান
সরকারের নারী সংস্কার কমিটি অন্যতম সদস্য । বেগম রোকেয়া
পদক সহ দেশী বিদেশী
অসংখ্য পদকে ভূষিত হয়েছেন । তার লেখা
বই সমভ্রম যোদ্ধা সেবাদসন ও একজন ডাঃ
হালিদা বইটি পাঠক সমাজের প্রসংশনীয় ।
হালিদা হানুম আখতার জানান, বইটিতে তিনি মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য
১৯৭২ সালে স্থাপিত ‘সেবাসদন’ নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন। যুদ্ধের সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। তিনি দেশে ফিরে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে যোগদান করে। এরপর ধানমন্ডি প্রতিষ্ঠিত ‘সেবাসদন’-এ নির্যাতিত নারীদের
চিকিৎসা ও পুনর্বাসন সেবা
দেয়া শুরু করেন। বইটি সেই অভিজ্ঞতার আলোকে লিখেছেন তিনি।
ডা. হালিদা হানুম আরও জানান, বইটিতে তিনি নির্যাতিত নারীদের কথা এবং তাদের মানসিক যন্ত্রণার বর্ণনা দিয়েছেন। অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নির্যাতনের ফলে গর্ভস্থ সন্তানকে গর্ভপাত করা বা জীবিত জন্ম
নিলেও তাকে কাছে না পাওয়া ইত্যাদি
বিষয়গুলো বইটিতে উঠে এসেছে বলে জানান তিনি। এছাড়া এসব গর্ভপাত শিশুদের দত্তক দেয়া হতো অনেক শিশু আমেরিকা ,কানাডা ,অস্ট্রেলিয়া সহ বিভিন্ন দেশে
দত্তক হিসেবে পাঠানো হয়েছে ।
একজন গুনী চিকিৎসক ডাঃ হালিদা হানুম আখতার তাঁর তরুণ সময়ে বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে স্বাধীনতার সাধ পেতে জীবনের সেরা সম্ভ্রমের বিসর্জন দিয়েছেন সম্ভ্রমযোদ্ধা নারীদের চিকিৎসা সেবায় আত্ম নিয়োগ করে ডাঃ হালিদা যে মহান ইতিহাসের
পাতায় গৌরবের ভূমিকায় সেটাও নতুন প্রজন্মের জানা উচিত। ডাঃ হালিদা একজন ব্যক্তি নন, সেবা ও জ্ঞান সমান
ভাবে সাধারণ মানুষের মাজে বিতরণ করে নিজেকে একটি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তিত করেছেন । পেয়েছেন সম্মান
হিসেবে দেশে বিদেশে একাধিক পুরস্কার । তাঁর সেবা কর্মযজ্ঞ সকলের মাজে ছড়িয়ে পড়ুক এ
আশা টা করতেই পারি।
0 Comments